top of page
Search

জামাই ষষ্ঠী



আমাদের দেশে প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো করার নানা ব্যাখ্যা ও লোকোক্তি রয়েছে। এমনই একটি বিশেষ পূজো মা ষষ্ঠীর পুজো। ষষ্ঠীদেবী দ্বিভুজা, দুনয়না, গৌরবর্ণা, দিব্যবসনা, সর্বসুলক্ষণা ও জগদ্ধাত্রী শুভপ্রদা। তিনি মাতৃত্বের প্রতীক। বিড়াল তাঁর বাহন। মূলত সন্তানের কল্যাণ ও সংসারের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করাই এই পুজোর উদ্দেশ্য। সাধারণত সন্তানের মঙ্গল কামনার্থে মায়েরা এই পুজো করে থাকেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে সন্তান প্রাপ্তির আশাতেও এই পুজো করা হয়।

জামাইষষ্ঠী একটি লোকায়ত প্রথা। ষষ্ঠীদেবীর পার্বণ থেকে এই প্রথার উদ্ভব। বহু যুগ থেকে জামাইষষ্ঠী পালন হয়ে আসছে। প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথিতে প্রথম প্রহরে ষষ্ঠী পুজার আয়োজন করা হয়। ষষ্ঠীর প্রতিমা কিংবা আঁকা ছবিতে পুজা নিবেদন করা হয়। কেউ কেউ ঘট স্থাপন করেও এই পুজো করে থাকেন।


কথিত রয়েছে, একবার এক গৃহবধূ স্বামীর ঘরে নিজে মাছ চুরি করে খেয়ে দোষ দিয়েছিলেন বিড়ালের উপর। ফলে তাঁর সন্তান হারিয়ে যায়। তাঁর পাপের ফলেই এই ঘটনা ঘটে বলে মনে করা হয়। তখন সেই মহিলা বনে গিয়ে ষষ্ঠীদেবীর আরাধনা শুরু করেন৷ দেবী তুষ্ট হন৷ ফলে বনেই তিনি নিজের সন্তানকে ফিরে পান। এই জন্যই ষষ্ঠীদেবীর অপর নাম অরণ্যষষ্ঠী।


এদিকে মাছ চুরি করে খাওয়ার জন্য শ্বশুর-শাশুড়ি ওই বধূর পিতৃগৃহে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এই অবস্থায় মেয়েকে দেখার জন্য ব্যাকুল মা-বাবা একবার ষষ্ঠীপুজোর দিন জামাইকে সাদরে নিমন্ত্রণ জানান। ষষ্ঠী পূজোর দিনে জামাই সস্ত্রীক উপস্থিত হওয়াতে কন‍্যার আগমনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় বাড়িতে। ষষ্ঠীপুজো রূপান্তরিত হয় জামাইষষ্ঠীতে।


বাঙালি হিন্দুসমাজে এ উৎসবের সামাজিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশেষত যে পরিবারে সদ্য বিবাহিতা কন্যা রয়েছে সেই পরিবারে এই পার্বণটি ঘটা করে পালন করা হয়। পুজোর সময় পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য পৃথক মালসার মধ্যে নতুন বস্ত্র, মৌসুমী ফলফলাদি, পান-সুপারি, ধান-দূর্বা ও তালের পাখা রাখা হয়। ভক্তরা উপোস রেখে মায়ের পূজা করেন। মালসা থেকে নতুন বস্ত্র পরিধান করে ফলফলাদি খেতে হয়।



প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, তা হলে জামাই ষষ্ঠীর উদ্দেশ্য কী। কী কারণে জামাই ষষ্ঠী পালন করা হয়? মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাই ষষ্ঠীর সম্পর্ক কী?


এক সময়ে সংস্কার ছিল যে, ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মেয়ের বিয়ের পর তার বাবা বা মা মেয়ের বাড়িতে তত দিন পর্যন্ত যেতে পারবেন না, যত দিন না মেয়ে সন্তানসম্ভবা হন বা সন্তানের জন্ম দেন।


এর ফলে মেয়ে কোনও ভাবে সন্তান ধারণে অক্ষম বা প্রসবে বাধা এলে বাবা-মায়ের দীর্ঘদিন কেটে যেত মেয়ের মুখ দর্শনে। বর্তমানে এই প্রথা একটু বদলে গিয়েছে। এখনকার যুগে নিয়ম হয়েছে, যিনি কন্যা দান করবেন, তিনি এক বছর মেয়ের বাড়িতে কিছু খেতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে বিবাহিত কন্যার মুখদর্শন কী ভাবে ঘটবে? তাই সমাজ বেছে নিল এই পথ। জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিনটিকে বেছে নেওয়া হল জামাই ষষ্ঠী হিসেবে। যেখানে মেয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হবে এবং তাঁদের সমাদর করা হবে। সঙ্গে মা ষষ্ঠীর পুজো করা হবে যাতে মেয়ে-জামাই শীঘ্রই সন্তানের মুখ দেখতে পারে।

এর ফলে মেয়ের মুখ দেখা সম্ভব হল। এই উৎসবের নাম হল জামাই ষষ্ঠী। এই দিন শাশুড়িরা খুব ঘটা করে এই পুজো করে থাকেন।


জামাই ষষ্ঠীর দিন জামাইয়ের হাতে হলুদ মাখানো সুতো বেঁধে দেওয়া হয় মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদ রূপে এবং মা ষষ্ঠীকে নিবেদিত তালপাতার পাখা দিয়ে "ষাট্ ষাট্ ষষ্ঠীর ষাট্"এই মন্ত্রে জামাই ও সন্তান সন্ততীদের বাতাস দেওয়া হয় এই বিশ্বাসে যে মা ষষ্ঠীর কৃপা বর্ষণ হবে।


প্রযুক্তিবিষয়ক আধুনিকতা এই বিশ্বাসগুলিকে প্রতিহত করতে পারেনি বরং এই অনুষ্ঠানে আড়ম্বর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে এই দিনটিতে সন্তান লাভের আশায় বিবাহিত মহিলারা মা বিন্ধ্যবাসিনী স্কন্দ ষষ্ঠীর পুজো করতেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে শুরু হত উপোস। এরপরে পাঁচ ধরনের ফল, মিষ্টি এবং ১০৮ টা দুর্বাবাঁধা আঁটি নিবেদন করে হত পুজো। মাকে নিবেদন করা হত ধান এবং আমের পল্লবও। পুজো শেষে প্রসাদ খেয়ে উপোস ভাঙা হত। সেই প্রথা আজও আছে। জামাই ষষ্ঠীর দিন অনেকেই এই সব নিয়ম মেনে মা ষষ্ঠীর পুজো করে থাকেন। সঙ্গে সমান তালে চলে জামাই নিয়ে জামাই ষষ্ঠী উদযাপনও!

পাটভাঙা নতুন পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে হাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে জামাইয়ের পদার্পণ হয়।সেইদিন জামাই আপ্যায়ণের রীতির সঙ্গে বাঙালিরা ওতোপ্রোতোভাবে পরিচিত।

আহা থালায় সাজানো রকমারি পদ। রকমারী পোলাও,মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল বা নারকেল দেওয়া ছোলার ডাল, পাঁচ ভাজা সুক্তো ইলিশ-চিংড়ি থেকে শুরু করে থরেথরে সাজানো সব সুস্বাদু খাবার। শেষপাতে মণ্ডা-মিঠাই কী নেই! ওদিকে শাশুড়ির ষষ্ঠী নিয়মও রয়েছে।

চলচ্চিত্রে বাঙালির জামাইয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল 'জামাই ষষ্ঠীরই' নামক সিনেমার কল্যাণে। ১৯৩১ সালে তোলা হয় বাংলার প্রথম সবাক কাহিনিচিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’। পরিচালক ছিলেন অমর চৌধুরী।

বাঙালি হিন্দু সমাজে জামাইষষ্ঠীর গুরুত্ব অনেক। সারা বছর ধরে সকলে অপেক্ষা করে থাকেন এই উৎসবের জন্য। নতুন বস্ত্র, উপহার, ফল- ফলাদি, পান-সুপারি, ধান- দূর্বা, বাঁশের করুল, তালের পাখা, করমচা দিয়ে শাশুড়ি মায়েরা উদযাপন করেন জামাইষষ্ঠী। তবে বর্তমানে সকলের ব্যস্ততার মধ্যে বহু রেস্তরাঁতে আয়োজন হচ্ছে, বিশেষ জামাইষষ্ঠীর। আর সকলে সেখানেই আদরে- যত্নে আপ্যায়ন করেন আদরের জামাইকে।

কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারীর কবিতা

"আজিকে জামাই ষষ্ঠী"

নতুন শাশুড়ী দের হয়তো দিক্ দর্শন করাতে পারে।


জামাইষষ্ঠী আজিকে ধূম হয় ভারি,

আসিবে জামাতা তাই ব্যস্ত সারাবাড়ি।

বাড়িঘর ছিম-ছাম কত আয়োজন,

শুভক্ষণে জামাতার হয় আগমন।


ইলিশের মাথা দিয়ে সুস্বাদু ব্যঞ্জন,

বিবিধ মিষ্টান্ন দ্রব্য না যায় বর্ণন।

রাজভোগ সীতাভোগ মিহিদান আর,

চিনি পাতা মিষ্টি দই হরেক প্রকার।


আম কলা কাঁঠালের ভেসে আসে গন্ধ,

তাই নিয়ে তিন শালী অধিক আনন্দ।

হেসে হেসে বসে এসে জামাতার পাশে,

জামাই-বাবুকে তারা অতি ভালবাসে।


সারাদিন হাসি খুশি আনন্দ সবার,

আগামী বর্ষের তরে প্রতীক্ষা আবার।

18 views0 comments

Comments


bottom of page